
যদি এই লেখাটি আপনার আজ পড়া না হতো
(২৭.০৪.২০২৫ তারিখে দৈনিক যুগশঙ্খের রবিবারের পাতায় প্রকাশিত)
ধরুন, যদি আজ কাগজ খোলাই হতো না। কতদিনই তো হয় এরকম। সকালে কিছু একটা ঝামেলা, কোন একটা কাজ, ব্যস্ততা, অথবা হয়তো হকার কাগজখানাই দিল না। অথবা কাগজ এত দেরিতে এল যে আপনার তখন আর সেটা পড়ার মত ফুরসত নেই। কিন্তু সত্যিটা হলো, এসবের কোনটাই আজ ঘটে নি। এই মুহূর্তে আপনি দৈনিক খবরের কাগজের রবিবারের পাতায় এই ঘুমপাড়ানি বোরিং লেখাটায় চোখ বোলাচ্ছেন। যদিও দিনটা আজ অন্যরকম হতেই পারত। কিন্তু হয়নি। এই যে ‘যা হয়নি কিন্তু হতেও তো পারত’ গোছের সমস্ত সম্ভাবনা – তার একটা কমন ইংরেজি নাম আছে। কাউন্টারফ্যাকচুয়ালস।
‘আপনার গিন্নি কিংবা স্বামীর সাথে আপনার বিয়ে না হলে কী হতো’ অথবা ধরুন ‘আপনার মনের মানুষটির প্রেমে যদি না পড়তেন তাহলে কী হতো’ এসব বলেটলে বিষয়টা ব্যাখ্যা করার বাহানায় আরেকটু রস ঢালা যেত। কিন্তু ওতে লাভ হতো না। তখন এ লেখার উদ্দেশ্য নিছক বিনোদন হয়ে দাঁড়াত।
কাউন্টারফ্যাকচুয়ালস-এর উপস্থিতি আমরা অনেক কিছুতেই দেখতে পাই। ইতিহাস, বিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা, দর্শন থেকে শুরু করে একেবারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অব্দি...
কাউন্টারফ্যাকচুয়ালস-এর উপস্থিতি আমরা অনেক কিছুতেই দেখতে পাই। ইতিহাস, বিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা, দর্শন থেকে শুরু করে একেবারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অব্দি। কী হলে কী হতো এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে ইতিহাসবিদেরা খুব পছন্দ করেন। ব্রিটিশ যদি ভারত দখল না করত তবে কী হতো? অথবা দেশভাগ যদি না হতো তবে কী হতো ইত্যাদি নানান বিচিত্র দৃশ্য তাঁদের মাথায় আসে। যেসব সিনেমার ওপর ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ ওঠে সেসব দেখতে দর্শকেরা আরও বেশি করে ভীড় করেন। আসলে ‘যা ঘটতে পারত কিন্তু ঘটেনি’ তার আকর্ষণ যা ঘটেছে তার থেকে অনেক বেশি। অথবা যা সত্যি বলে এতদিন জেনে এসেছি তার থেকে আলাদা কিছু যদি কোন ছবিতে থাকে তবে সেটা দেখার একটা আগ্রহ সবার মনেই আসে।
গোল্ডিলকস-এর গল্প মনে আছে? ছোটদের রূপকথার গল্প। সোনালী চুলের একটা ছোট্ট মেয়ে একদিন জঙ্গলে পথ হারিয়ে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটা বাড়ি দেখল এবং ভেতরে ঢুকে পড়ল। বাড়িটা আসলে ছিল তিনটি ভালুকের। বড় ভালুক, মেজ ভালুক আর ছোট ভালুক। দুপুরের রান্নাবান্না সেরে ভালুকভায়ারা একটু হাঁটতে বেরিয়েছিল। ফিরে এসে লাঞ্চ করার প্ল্যান। মেয়েটি প্রথমে বড় ভালুকের প্লেট থেকে একটুখানি খাবার মুখে দিয়ে দেখল। বড্ড বেশি গরম। মেজ ভালুকের থালা থেকে খেয়ে দেখল একেবারে ঠাণ্ডা। শেষে ছোট ভায়ের প্লেটের খাবারটাই পছন্দ হলো তার। বেশি গরম নয় আবার ঠাণ্ডা ও নয়। ঠিক মাপমত। খাওয়া শেষ, এবার ঘুম। বড় ভালুকের বিছানাতে শুয়ে দেখল মাথার দিকটা বড্ড বেশি উঁচু। মেজ ভালুকের বিছানায় দেখা গেল মাথার দিকটা নিচু, পায়ের দিকটা উঁচু। শেষমেশ ছোট ভালুকের বিছানাটাই পছন্দ হলো তার। মাথার দিকটা খুব উঁচুও নয়, নিচু ও নয়। একদম ঠিকঠাক। সে ঘুমিয়ে পড়ল। এরপর কী হলো জানতে হলে গল্পটা খুঁজে নিয়ে পড়ে দেখুন। আমরা আলোচনায় ফিরি।
আমরা যে বেঁচে আছি সেটাকে একটা মিরাকল বলা যেতে পারে। মানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যতটুকু খবর মানুষ নিতে পেরেছে - কোথাও তো প্রাণের কোন চিহ্ন নেই। প্রাণধারণ তো সোজা নয়। একগাদা ব্যাপার যদি ঠিকঠাক হয় তবেই প্রাণের সৃষ্টি হতে পারে এবং সেটা টিকে থাকতে পারে। পৃথিবী যেমন সূর্য থেকে বেশি দূরে ও নয় আবার বেশি কাছে ও নয়। বেশি কাছে বুধ গ্রহ। প্রচণ্ড গরমে সব কিছু পুড়ে ছাই। আবার ইউরেনাস নেপচুনের মত বেশি দূরের কোন ঠান্ডা গ্যাসের গ্রহে কি আমরা বেঁচে থাকতে পারতাম? পৃথিবীর চলার পথটা যদি অনেকটা গোলমত না হয়ে বেশি চ্যাপ্টা বা লম্বাটে হত তবে সূর্যের কাছে এলে পুড়ে যেতাম আর দূরে গেলে ঠাণ্ডায় জমে যেতাম। মাধ্যাকর্ষণ বেশি বা কম হলেও মুশকিল। তরল জল আর শ্বাস নেবার মত বাতাস না থাকলেও মুশকিল। তাছাড়া পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড মায়ের আঁচলের মতই আমাদের ঘিরে রাখে। ক্ষতিকর কোন অপার্থিব রশ্মি আমাদের গায়ে লাগতে দেয় না। ব্যাপারটা যেন জঙ্গলের ভেতর ভালুকের বাড়ির মতই। সবকিছু এক্কেবারে মাপমত। একটি নক্ষত্রের আশেপাশে যে অঞ্চলটি প্রাণধারণের পক্ষে উপযুক্ত বিজ্ঞানীরা তার নাম রেখেছেন গোল্ডিলকস জোন। শুধু পৃথিবী বা সৌরজগতই নয়, এই গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা যেন আমরা থাকব বলেই তৈরি হয়েছে। হিসেবের একটু এদিক ওদিক হলেই আর দেখতে হতো না। বিজ্ঞানীরা কেউকেউ বলেন, দেখার জন্য আমরা হাজির আছি বলেই মহাবিশ্ব এরকম। কথাটা চট করে হজম হতে চায় না। আবার দেখুন রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন,
"আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে, জ্বলে উঠল আলো পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম "সুন্দর', সুন্দর হল সে।"
কী বলতে চাইছে গো বুড়োটা? মুশকিল হয়েছে, কবিতার আমি কিছুই বুঝি না। তবে আমার মনে হয় বিজ্ঞানীরা যেটা বলতে চাইছেন সেটা খুবই সাদামাটা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যেখানে যেখানে জীবন বা প্রাণ নেই সেখানে নালিশ করারও কেউ নেই। সেখানকার নিয়ম এবং ঘটনাগুলো আমাদের দুনিয়ার মত নয় - সব আলাদা। হয়তো সেখানে পান্না ধূসর আর চুনি বদখত বাদামি। কিন্তু সেসব যে পছন্দ হচ্ছে না অথবা সবকিছুই যে অন্যরকম সে কথা বলবেটা কে? কেউ তো নেই আশেপাশে। এই কথাটাকেই মাখন চিনি লাগিয়ে একটু ভদ্রভাবে পেশ করা হচ্ছে আর কি। এখন তাহলে কি কথাটা মেনে নেওয়া যায়? আমরা আছি বলেই বিশ্বটা এরকম? ভাবুন।
সাথে এটাও ভাবুন যে কত কত কাউন্টারফ্যাকচুয়ালস তো চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কতকিছুই তো ঘটতে পারত। কিন্তু সেসব ঘটল না। যা হয়েছে সেটাই হলো। কেন কেন? কেন এই বিশেষ আয়োজন? তবে কি গড আল্লা ঈশ্বর এসব সৃষ্টি করেছেন? দাঁড়ান, কে বলেছে এটা বিশেষ? হয়তো জাস্ট বাই চান্স। আমরা দেখছি অনুভব করছি বলেই বিশেষ ঠেকছে। নইলে এই সংযোগ তো অগুনতি সম্ভাবনার মধ্যে একটি সাধারণ সম্ভাবনামাত্র। সম্ভাবনার সমাজে নেহাতই এক আম আদমি। এর মধ্যে খাস তো কিছু নেই। আমি আছি, দেখছি, হাত পা নাড়ছি, মন্তব্য করছি বলেই আমার চোখে একে সাংঘাতিক কিছু একটা মনে হচ্ছে। চিড়িয়াখানার প্রবেশদ্বারে টাঙানো পেল্লায় ম্যাপের তলায় দেখবেন একটি বিন্দুকে তীরচিহ্ন দিয়ে নির্দেশ করা থাকে। তার তলায় লেখা থাকে, ‘ইউ আর হিয়ার’, ‘আপ ইয়াহাঁ হ্যায়’, ‘আপনি এখানে আছেন’। একটু ভেবে দেখলেই বুঝবেন, বোর্ডের তলায় কোন মানুষ এসে দাঁড়ালে তবেই কথাটা সত্যি হয়ে ওঠে – নইলে নয়। এই ব্যাপারটাও সেরকমই। আপনি আছেন, সবকিছু দেখছেন বলেই একে স্পেশাল মনে হচ্ছে। নইলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কীভাবে গড়ে উঠতে পারত তার অসংখ্য উপায় ছিল। এবং সেসবের বেশিরভাগেই মানুষ, নেটফ্লিক্স, স্মার্টফোন, পিৎজা ইত্যাদির দেখা মেলার কথা ছিল না। এটা হঠাৎ করে হয়ে গেছে আর কি। এতে অত অবাক হবার কী আছে? পণ্ডিতেরা বলেন, বানরও নাকি ঠুকে ঠুকে শেক্সপিয়ারের কাব্য লিখে ফেলতে পারে। দরকার শুধু দুটো জিনিসের – অন্তহীন সময় এবং একটি অক্ষয় টাইপরাইটার। ও হ্যাঁ, তার সাথে বানরকেও অমর হতে হবে বৈকি।
আমাদের জীবনটা তাহলে কি একটা কাউন্টারফ্যাকচুয়াল মিরাকল? আশ্চর্য ঘটনা? তিলিসমাতি কেরামত? একটু ভেবে দেখলে মনে প্রশ্ন জাগে, আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটি মুহূর্তই কি অসংখ্য অপূর্ণ সম্ভাবনার ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে? এটা কাব্য নয়, বিশুদ্ধ গণিত – প্রোবাবিলিটি। সৃষ্টিতত্ত্ব বা মহাবিশ্ববিজ্ঞানের কেতাবে প্রায় তিরিশখানা ধ্রুবক বা কনস্টান্টের নাম লেখা আছে যাদের মান একচুল এদিক ওদিক হলেই গোটা ব্রহ্মাণ্ডটা অন্যরকম হতো এবং জীবনকে আমরা যেভাবে জানি সেই অর্থে জীবন বা প্রাণের সৃষ্টিই হয়তো হতো না। এই ভ্যালুগুলো বিজ্ঞানীদের মেপে বের করতে হয় এবং ফিজিক্সের ইকোয়েশনে দরকারমত এদের পুরে দিয়ে তারপর জগৎ সংসারের নানা কাণ্ডকারখানার ব্যাখ্যা তাঁরা করতে পারেন। যেমন ধরুন, আলোর গতি, গ্র্যাভিটেশনাল কনস্টান্ট, ফাইন স্ট্রাকচার কনস্টান্ট ইত্যাদি। এদের মান যা আছে তা কেন আছে? অন্য রকম কেন হয় নি?
কিন্তু এই জ্ঞান দিয়ে আমি করবটা কী? কোন কাজে আসবে এটা? বিজ্ঞানীদের কাজে এলেও হয়তো আপনার আমার কোন কাজেই আসবে না। তবে এটুকু হয়তো উপলব্ধি করতে পারব যে আমাদের জীবনটা কত ঠুনকো কত অদ্ভুত। প্রকৃতির এক খামখেয়ালের ফলে আমি সৃষ্ট হয়েছি এবং নিঃসঙ্গ মহাকাশে মাপমত বসানো শূন্যে ধাবমান এক বৃহৎ প্রস্তরখণ্ডের ওপর বসবাস করে চলেছি। এটাই আমাদের মোবাইল গৃহ। প্রতি ঘণ্টায় ১০৭০০০ কিলোমিটার গতিতে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরে চলেছে। সূর্য প্রদক্ষিণ করে চলেছে মিল্কি ওয়ে বা ছায়াপথের কেন্দ্রবিন্দুটিকে। গতিবেগ ৮২৮০০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। আর ছায়াপথের চলন ভাবতে গিয়ে তো মাথাই ঘুরে যাচ্ছে আমার। থাক। কোন এক ভাবে মস্ত এক মহাজাগতিক লটারি জিতেছি বলেই আমরা আছি, আমাদের অস্তিত্ব অনুভব করছি।
কাউন্টারফ্যাকচুয়াল চিন্তাধারা দিয়েই আমরা আমাদের চারপাশের জগতটাকে জানার বোঝার চেষ্টা করি। কাজের এবং অকাজের নানা প্রশ্ন মানবজাতির জ্ঞান বাড়ায়, আনন্দ দেয়। যেমন ধরুন, সুরলোকের গাছের আপেল যদি অ্যাডামের মাথায় এসে পড়ত তাহলে কি নিউটনের বদলে তিনিই মাধ্যাকর্ষণের আবিষ্কর্তা হতেন? যদি একজন লোকের বাবা ও মায়ের দেখাই হতো না তবে কী হতো? অ্যাস্টরয়েডের ধাক্কায় ডাইনোসরেরা যদি কুপোকাত না হতো তবে পৃথিবীটা এখন কেমন হতো? চাঁদ যদি না থাকত তবে কি আমাদের কোন অসুবিধে হতো?
সবশেষে একটা প্রশ্ন করব যা একটুও শক্ত নয়। কথাটা শুরুতেই বলেছি।
‘যদি এই লেখাটি আপনি না পড়তেন তবে কী হতো?’
আপনার মাথা ঝিমঝিম করত না। একা আমারই করত।
অ সা ধা র ণ - পড়লাম বলেই বললাম । না পড়লে কী হত ! কিছুই হতো না, পৃথিবী আগের মতোই ঘুরপাক খেতো ।
ReplyDeleteঅসাধারণ বললে কিছুই বলা হয় না। অনবদ্য। লেখককে শুভেচ্ছা ও নমস্কার। না পড়লে এমন "অকাজের আনন্দ আর জ্ঞান" মিলত না।
ReplyDeleteদিলে তো মাথাটা ঝিমঝিম করিয়ে
ReplyDelete