ন্ধে থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল। গিন্নী যুত করে বানিয়েছিলেন আমার অত্যন্ত প্রিয় পদ সরষে ইলিশ। খুব মজা করে খাচ্ছিলাম। গিন্নী বলছিলেন বটে রাতের বেলায় সরষে বেশি খেও না, পেট গরম হবে, বয়স তো কম হয় নি ইত্যাদি। সরষে ইলিশের সাথে এরকম ঘ্যানর ঘ্যানর করলে মানায় কখনো, বলুন! আমি সেদিকে কান না দিয়ে গপাগপ খেয়েই যাচ্ছিলাম। মাঝখানে গলায় একবার কাঁটা ও আটকে গেছিল। যাই হোক, খেয়েদেয়ে তারপর ঠিক এগারোটায় শুয়ে পড়েছি। মাঝরাতে হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘুমচোখে দরজা খুলে দেখি, একি! আমার তিনতলার ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে স্বয়ং কিশোর কুমার !!!
পরনে একটা ঢিলে জোব্বা মত পোষাক। এরকম একটা অদ্ভুত সাজে আগে তাঁকে কখনো দেখি নি। কিশোর কুমার তো একটু ইয়ে - মানে মাথায় একটু ছিট তো আগে থেকেই ছিল। নিজের বাড়ীতে না কি সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলেন, ‘কিশোর কুমার হইতে সাবধান!’ সবই মুডের ব্যাপার। আজকের পোষাকটা ও সেই মুডেরই বহিঃপ্রকাশ হবে হয়তো। সাথে কে একজন লম্বা, দাড়ি অলা, বুড়ো মত লোক। কোথায় যেন দেখেছি লোকটাকে। লোকটা পরে আছে কোট প্যাণ্ট, আর হ্যাট। অনেকটা যেন কিশোর কুমার স্টাইল। যাই হোক, মাঝরাতে কিশোরদা কে দেখে আমার তো আক্কেল গুড়ুম। বলতে চাইছি, ভেতরে আসুন, বসুন, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। দরজা ছেড়ে একটু সরে দাঁড়াতেই ওঁরা ঢুকে সোফাতে বসলেন।
কিশোরদাকে কোন গানটার ফরমাইস করব ভাবছিলাম। হঠাৎ কিশোরদা নিজেই বললেন, এনাকে চিনতে পার নি, মনে হচ্ছে।
- না মানে, ঠিক...
- আরে, ইনি রবীন্দ্রনাথ।
- কোন রবীন্দ্র নাথ? বম্বে মানে মুম্বই তে তখন আপনার সাথে রবীন্দ্র নাথ নামে কেউ ছিল বলে তো মনে পড়ছে না!
- আরে দূর, বম্বে নয়, শান্তিনিকেতন। ইনি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আরেকটু হলেই মাথা ঘুরে পড়ে যেতাম। ভালো করে চোখ কচলে তাকিয়ে দেখি, তাই তো, কোট, প্যাণ্ট, হ্যাটের ভেতর তো সেই সৌম্যকান্তি ঋষি পুরুষটি। দিব্যি আমার সামনে সোফায় বসে আছেন। যাঃ বাবা। স্বপ্ন দেখছি না তো? নিজের গায়ে বড় করে একটা চিমটি কাটলাম। একটু ও লাগল না। বুঝলাম, স্বপ্ন নয়, এ একেবারে নির্জলা সত্যি।
কিশোরদা বললেন, ‘এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ গুরুদেব বললেন, ‘মাথায় একটা গান এসেছে।‘ জানোই তো গান পাওয়া অনেকটা বাথরুম পাওয়ার মতই। বেগ এলেই সেরে নিতে হয়। দেরী করা চলে না। তা গুরুদেব জানতে চাইছিলেন, ‘এখানে আশেপাশে এমন কি কেউ আছে যে সুরটা স্বরলিপিতে ধরে রাখতে পারবে?’ আমি বললাম সেরকম কেউ নেই বটে, তবে একটা আধবুড়ো লোক আছে যে আমার গান পছন্দ করে আর আপনার গান ও ভালোবাসে। তাইতে গুরুদেব বললেন, আচ্ছা, চল, একবার চেষ্টা করে দেখি।‘
কিশোরদা কে বললাম, ‘সেসব নাহ্য় হবে। কিন্তু, আপনারা এভাবে পোষাক বদল করেছেন কেন? আপনি চাপিয়েছেন গুরুদেবের জোব্বা আর ওনাকে তো কখনো কোট প্যাণ্টে দেখিনি। তার ওপর মাথায় টুপি। স্বর্গে ও কি এখানকার মত ‘গো এজ ইউ লাইক’ কম্পিটিশন আছে না কি?’ কিশোর কুমার বললেন, ‘ও সব তুমি বুঝবে না। আর, আমি তো কোন দিনই কোন নিয়ম মানি নি- য়েহী মেরা স্টাইল হ্যায়।’ মনে খুব জোর এসে গেলে কিশোরকুমার যে হিন্দীতে কথা বলা শুরু করে দেন এটা আগে জানা ছিল না।
গুরুদেব এবার মুখ খুললেন। ‘তুমি আকারমাত্রিক স্বরলিপি জানো তো হে?’
- ‘খুব জানি, স্যার। আপনার স্বরবিতান পড়ে পড়ে শিখে গেছি। জানেন, স্যার, আমি তো নিজে গাইতে পারি না। যখন আপনার গান শোনার কোন উপায় থাকে না, তখন আমি স্বরলিপি খুলে সারেগামা গুলোর ওপর হাত বোলাই। তাতে অনেক আরাম হয়। মনে শান্তি আসে।'
- ‘বুঝেছি। তোমার মাথায় একটু ছিট আছে। বাড়ীতে তানপুরা আছে?’
- ‘আজ্ঞে না। হারমোনিয়াম আছে। সেটা দিয়ে আমার বৌ আপনার গানই করে। আনবো?’
গুরুদেব যেন একটু বিরক্ত হলেন। কিশোরদার দিকে একবার তাকালেন। কোথায় কী ভুল হল বুঝলাম না। অমনি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘একটা ইয়ামাহা কীবোর্ড আছে। আমার ছেলে বাজায়। আর মোবাইল ফোনে ইলেকট্রনিক তানপুরা ও আছে।‘ গুরুদেব কিছু বললেন না। বুঝলাম, মৌনম সম্মতিলক্ষণম। সব নিয়ে এলাম।
বললাম, ‘গুরুদেব, কিছু মনে না করেন যদি, একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আপনি নতুন গান তোলার জন্যে কিশোরদা কে নিয়ে এলেন কেন? সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এরা সবাই মারা- মানে ইয়ে মানে দেবলোকেই তো আছেন!’
গুরুদেব এবার ও জবাব দিলেন না। কিশোরদা আমাকে বললেন, ‘হাতে বেশি সময় নেই। তুমি এবার কীবোর্ডে এফ মেজর টা ধর তো।‘ বলে গুরুদেবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঠিক আছে তো, গুরুদেব?” গুরুদেব ঘাড়টা সামান্য নাড়লেন। যার অর্থ, হ্যাঁ। আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না।
-‘এসব কী হচ্ছে? গুরুদেব, একি করছেন আপনি? আর যাই হোক, রবীন্দ্রসঙ্গীতে এভাবে হয় না। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি আপনার গান সব সময় নীচু পর্দা থেকে দাঁত চেপে গাইতে হয়। সেখানে আপনি এফ মেজর স্কেল করেছেন? হারমোনিয়ামের বাঁদিকটায় তিনটে কালোচাবির মাঝখানেরটা, ওই যে আপনারা যাকে জি শার্প বলেন, হ্যাঁ, সেটাই বলছি - তলার দিকে ‘জি শার্প’ কি ‘এ’ কি নিদেনপক্ষে ‘বি-ফ্ল্যাট’ করলে ভালো হত না? কত লোকই তো ‘বি ফ্ল্যাট’-এ গান করেন। তাছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীতে গায়কী বলে একটা ব্যাপার আছে। কত ভালো ভালো আর্টিস্ট ফেলে আপনি নিয়ে এলেন কি না কিশোর দা কে? আমি ওনার বড় ফ্যান। সেসব ঠিক আছে। কিন্তু কিশোরদার গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত? আপনি ওনার রেকর্ড শোনেন নি?’
গুরুদেব এবার পূর্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। পাঁচ সেকেণ্ড পর শান্ত অথচ গম্ভীর গলায় শুধু বললেন, ‘বাপু হে, আমার গান কি তুমি আমার থেকে বেশি বোঝ?’
এর পর আর কোন কথা চলে না। রবীন্দ্রনাথ নিজেই যদি রবীন্দ্রসঙ্গীতের নিয়ম কানুন জানেন না, তো আমি আর কিই বা করতে পারি। যাক গে, মরুকগে। আমি মুখে কুলুপ দিলাম। কিশোর দা হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘গান গুলো আমি উঁচু থেকেই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা বলল, নীচু থেকে করতে।‘ গুরুদেব নিশ্চুপ। তাঁকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল যেন।
ইউটিউবে তানপুরা তখন থেকেই বাজছিল। কিশোরদার ইশারায় আমি এবার অগ্যতা এফ মেজর কর্ড টাই চেপে ধরলাম। কীবোর্ডের টুং টাং আওয়াজে গুরুদেবের যেন সম্বিত ফিরে এল। তিনি কিশোর দা কে ‘আমার সাথে ধরো’ বলে 'সা' তে সুর লাগালেন। গান এগিয়ে চলল। সঙ্গীতের দুই বিরল ব্যক্তিত্বের ডুয়েটে আমার পনের বাই দশ মাপের ড্রয়িং রুম টা যেন স্বর্গের সভা হয়ে উঠল। তারপর কিসে কি হল জানি না, হঠাৎ একটা বেসুরো আওয়াজ কোত্থেকে কানে আসতে লাগল। সুরের মাঝখানে বেসুর বড্ড কানে বাজে। আমার কর্ডগুলো যেন আর ঠিক জায়গা মত বসছিল না।। মাইনর মেজর সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল...
গিন্নীর আওয়াজে চোখ খুললাম। ঘড়িতে সকাল ছ’টা। টিভির পর্দায় নামী শিল্পী গুরুদেবের গান ধরেছেন। এদিকে গিন্নী যথারীতি ‘গুড মর্নিং ব্রডকাস্ট’ শুরু করে দিয়েছেন। ‘কত বেলা হল। দুধ আনতে যেতে হবে না? খালি পড়ে পড়ে ঘুমোলে চলবে? সংসারের একটা কাজ যদি লোকটাকে দিয়ে হয়!‘
সকালের কড়া চায়ের কাপে চুমুক দিতেই মাথাটা সাফ হয়ে এল। কিশোরদা আর গুরুদেবের মিলটা কোথায় সেটা যেন এবার স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। অনেক সিনেমাতে এমন ও হয়েছে যে একই গান কিশোর কুমার ও গেয়েছেন আবার অন্য শিল্পী ও গেয়েছেন। যেমন ‘তুম বিন জাউঁ কাঁহা’ (মহঃ রফি), ‘হমে তুমসে প্যায়ার কিতনা’(পরবিন সুলতানা), ‘মেরে নয়না, শাওন ভাদোঁ’(লতা মঙ্গেশকর), ‘ও সাথি রে, তেরে বিনা ভি ক্যায়া জিনা’(আশা ভোঁসলে)। প্রতিটি গানেই জনপ্রিয়তার নিরিখে কিশোরকুমার অনেক বেশি এগিয়ে। কোন পুরস্কার না পাওয়া এক ‘অশিক্ষিত’ গায়কের সাথে প্রতিযোগিতায় বারেবারেই পিছিয়ে পড়তে হয়েছে ‘সরগম’ গুলে খাওয়া প্রথিতযশা শিল্পীদের। কেন? লতা, আশা ও পরবিন এর গান গুলোতে সুরের কাজ অনেক বেশি ছিল। আর কিশোর কুমার গেয়েছেন নেহাত সাদামাটা ভাবে। কিন্তু শ্রোতার মন কে ছুঁতে পেরেছেন। কেন? প্রাণ থেকে গেয়েছেন বলে? তবে কি, রবীন্দ্রনাথের কথাটাই ঠিক? বুড়ো বলত বটে, যে গান হৃদয়ের যত গভীর থেকে ওঠে, সে শ্রোতার হৃদয়ের ততটাই গভীরে স্পর্শ করে। কথাটা তখন বুঝি নি। এখন মনে হচ্ছে নিজের গানের কথা ও সুর কে তাই তিনি যতটা সম্ভব সহজ রেখে ছিলেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কুস্তির লড়াই তাঁর বিলকুল না-পসন্দ ছিল। তিনি ভাবতেন কথা ও সুর দুজনেই নিজের জায়গা থেকে খানিকটা নেমে এসে যখন একে অপরের হাত ধরবে তখনই হবে লক্ষী-সরস্বতীর মিলন। গুরুদেবের সাথে কিশোরকুমারের বড় মিল কি এখানেই? দুজনেই ছিলেন পাক্কা সহজিয়া। সেজন্যেই কি সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবিতে কিশোরদাকে দিয়ে কবিগুরুর গান গাইয়েছিলেন? আর তাই বুঝি স্বপ্নের ভেতর দুজনে পোষাক বদলা বদলি করেছিলেন?
গলার ভেতরটা যেন একটু খচখচ করছে। রাতের কাঁটাটা কি এখনো লেগে রইল?
(কিশোরকুমারের প্রয়াণদিবসে অধমের শ্রদ্ধাঞ্জলি – ত্রিদেব চৌধুরী)
আরো পড়তে চান? আমার ফেসবুক পেজ লাইক করে রাখুন। নতুন লেখা বেরোলেই আপনার কাছে খবর চলে আসবে।View Author Profile
চমৎকার লেখা। চালিয়ে যান ত্রিদেব চৌ়ধুরী।
ReplyDelete