টবেলায় পড়েছিলাম কলম নাকি তলোয়ারের চেয়ে অনেক ধারালো, অনেক শক্তিশালী। এতদিন তাই ভাবতাম। এখন লিখতে বসে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। বুধবার বঙ্গভবনে যে নাটক দেখলাম তাকে কাগজের পাতায় ফুটিয়ে তোলার কনফিডেন্স অন্ততঃ আমার কলমে নেই। নাট্যকার অরিজিৎ আদিত্য ও নির্দেশক অভিনেতা সুব্রত রায়ের প্রতিভার সামনে নতজানু হয়ে এ লেখা লিখছি।

নাটকটি প্রথমবার মঞ্চস্থ হয়েছিল দিল্লীতে। এবার শিলচরে হল। এ নাটকের যেটা ক্যানভাস, দুরূহ বাংলায় যাকে বলে পটভূমিকা, সেটা বরাক উপত্যকার তো বটেই গোটা অসমের সবারই জানা। তবে ভারতবর্ষের বেশির ভাগ লোকই এ নিয়ে খুব একটা কিছু জানেন না।
গল্পের মুখ্য চরিত্র অর্জুন নমশূদ্র এক ‘ডি-ভোটার’। এই ‘ডি-ভোটার’ বা ডাউটফুল ভোটার শব্দটি অসমের বাঙালীদের জন্যে আতঙ্কের অপর নাম। কারো নামে একবার যদি এই ‘ডি-ভোটার’ নোটিস আসে তবে তিনি নিজভূমেই পরবাসী হয়ে গেলেন। তাঁকে এবার আদালতে প্রমাণ করতে হবে তিনি ভারতের নাগরিক। মাননীয় গৌহাটি হাইকোর্টের আদেশ মত বিচার না হওয়া পর্যন্ত ‘ডি-ভোটার’ দের ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক করে রাখতে হয়। রাজ্যের অনেক জায়গায় জেলগুলিকেই ডিটেনশন ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে, যার নাগরিকত্ব সন্দেহজনক তাকে বন্দীজীবন কাটাতে হচ্ছে চোর ডাকাত খুনী দের সাথে। বছরের পর বছর এভাবে বিনা বিচারে বন্দী জীবন কাটানোর পর কেউ কেউ মারা যাচ্ছেন, নয়ত আত্মহত্যা করছেন। নাটকের হিরোকে নাট্যকার বাস্তব জীবন থেকেই ধার করেছেন। বাস্তবের অর্জুন নমশূদ্র যদি ও শেষমেশ আত্মহত্যার পথই বেছে নিয়েছিল। নাটকের অর্জুন কিন্তু তা করে নি।

নাট্যকার খুব গুছিয়ে অর্জুন নমশূদ্রের গল্পটা বলেছেন। একদম ডিটেলে। এবং সমস্যার সমাধান কোন পথে, সব শেষে তাও বলেছেন।
হাওর থেকে মাছ ধরে অর্জুন তার সংসার চালাত। ‘মৎস্য মারিব খাইব সুখে’ কথাটা তার বেলায় ও খাটত শুধু যদি ওই নোটিস টা আসত না। নিজের লিগাসি কোড না জানলে এনআরসি র খাতায় নাম উঠবে না। নিজেকে এ দেশের নাগরিক বলে প্রমাণ করা যাবে না। অর্জুন তাই হন্যে হয়ে তার নিজের শেকড়কে খুঁজছিল।
নাটকের পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল দেশভাগের যন্ত্রণা, আমাদের বাপ ঠাকুর্দাদের কষ্ট। শুধু মাটি দিয়ে তো একটা দেশ গড়ে ওঠে না। তার সাথে জুড়ে থাকে সেখানকার মানুষের সুখ, দুঃখ, আবেগ, ভালোবাসা। সেই আবেগ যে কতবার খণ্ডিত হয়েছে, অপমানিত হয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে তার হিসেব হয়তো ইতিহাসে নেই বা থাকবে ও না। এই নাটকটি যেন তার এক অসামান্য দলিল হয়ে রইল।

দেশ ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। নাট্যকার কিন্তু সব শেষে মেসেজ দিলেন ধর্ম নয়, ভাষাই হচ্ছে আমাদের আসল ঐতিহ্য, আমাদের অকৃত্রিম লিগ্যাসি। তার কোড ১৯শে মে,১৯৬১। ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে যেদিন এগারোটি তাজা প্রাণ শহীদ হয়েছিল। শুধু অর্জুন নয়, আমাদের সবারই ওই একই লিগ্যাসি কোডঃ ১৯-০৫-১৯৬১।
অরিজিৎ বাবু সোজাসুজি মানবাধিকারের কথাই বলেছেন। ভেদাভেদ ভুলে বাংলা মায়ের আঁচলের ছায়ায় এসে নতুন করে একসাথে পথ চলার ডাক শেষের দিকে একেবারে সুস্পষ্ট।
এবারে আসি অভিনয়ের কথায়। নেতার চরিত্রে বিভাস রায় ও শহীদ কমলা ভট্টাচার্য র ভূমিকায় রুমি রায় যথাযথ। এত কম সময়ে এর বেশি তাদের করার কিছুই ছিল না। এক ঘণ্টা দশ মিনিটের নাটকে এই দুজনকে মঞ্চে দেখা গেছে যথাক্রমে তিন মিনিট ও পাঁচ মিনিট।

সুব্রত বাবু একাই প্রায় দশটি চরিত্রে অভিনয় করলেন। শুরুতে একটু অবাক হচ্ছিলাম। 'গণসুর'-এ দক্ষ অভিনেতার তো কোন অভাব নেই। তবে? নাটক একটু এগোতেই কারণটা বোঝা গেল। দেখলাম অতগুলি চরিত্রে রূপদান করে সুব্রত রায় অভিনয়ের ব্যাপারটাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। হলভর্তি দর্শক হাঁ করে সুব্রত বাবুর কাণ্ড কারখানা দেখছিলেন। বঙ্গভবনের অত বড় স্টেজে তিনি যে একাই অভিনেতা তা কাউকে বুঝতেই দিলেন না। মনে হচ্ছিল, সমস্ত চরিত্রগুলো মঞ্চ জুড়ে চলাফেরা করছে, ডায়লগ বলছে। কস্টিউম, মঞ্চসজ্জা, প্রপস্ এসবকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে শুধুমাত্র দর্শকের কল্পনা শক্তির ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতার ওপর ভরসা রেখে একাই নাটক টেনে নিয়ে গেলেন সুব্রতবাবু। অভিনয় একটা পারফর্মিং আর্ট, সুব্রত বাবু আবার নতুন করে প্রমাণ করলেন। এমন কি ইমোশনাল দৃশ্যে ও তিনি ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ। দিদিমার অর্জুনকে বুকে জড়িয়ে ধরা কিংবা মিজান চাচা ও অর্জুনের কোলাকুলির দৃশ্যে দর্শকদের স্বতস্ফূর্ত হাততালিতে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তাঁর একক অভিনয়ের শিল্প কুশলতা। সুব্রতবাবুর এই যে ম্যাজিক, একে ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। যারা দেখেন নি তারা বড্ড মিস করলেন।

সেবায়ন রায় চৌধুরীর আবহ বেশ ভালো। শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের গাওয়া দুটি গান একেবারে বুকে এসে লাগে। সুরে মোড়া ব্যথা যেন মিছরির ছুরি। বাংলা ফোক যে তিনি অত ভালো গাইতে পারেন, আগে জানতাম না। একা নাটক করতে গেলে আলোর একটা বিশেষ ভূমিকা থাকেই। এখানে ও ছিল। আলোর কাজ ও ভালোই বলতে হবে।
সবশেষে প্রাণভরা ধন্যবাদ জানাতে হয় শিলচরের ভাষা শহীদ স্টেশন স্মরণ সমিতি ও দিল্লীর যুক্ত ফাউণ্ডেশন কে। এ কাহিনী তো একা অর্জুন নমশূদ্রের নয়, এ আমাদের সবার গল্প। ভুল বললাম, গল্প কেন হবে? এ তো সত্য। আগুনে পোড়া সোনার মত ষোল আনাই খাঁটি। আমাদের কষ্টের কাহিনীকে দিল্লীর মঞ্চে সবার সামনে তুলে ধরলেন তারা। এর জন্যে বিশেষ করে যুক্ত ফাউণ্ডেশনের সুবিমল ভট্টাচার্যের কাছে আমরা সবাই ঋণী। শিলচরের মঞ্চায়ন ও সম্ভব হয়েছে এদেরই সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায়। আমাদের বঞ্চনার কথা এতদিন আমরা লোকের কাছে পৌঁছে দিতে পারি নি। এই বোধ হয় তার শুভারম্ভ হল। দরকার ও ছিল। কারণ, নাটক তো শুধু শিল্প নয়, সংগ্রাম ও বটে।
(আরো পড়তে চান?
আমার ফেসবুক পেজ লাইক করে রাখুন। নতুন লেখা বেরোলেই আপনার কাছে খবর চলে আসবে।)
– ত্রিদেব চৌধুরী

অনবদ্য পর্যালোচনা।
ReplyDeleteঅভিনন্দন দাদাভাই।।
পড়লাম। ভালো লাগল।
ReplyDelete