Skip to main content

শিলচরের নাটকে বসন্তের হাওয়া


নিবার শিলচর ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরির অডিটোরিয়ামের মঞ্চের পর্দা যখন খুলল, ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক ছ’টা। শুরু হল সারস্বত নাট্য উৎসবের দ্বিতীয় রজনীর প্রথম নাটক – আজ বসন্ত। রচনা ইন্দ্রনীল দে। নির্দেশনা ও সঙ্গীত পরিচালনা সায়ন বিশ্বাস। দলের নাম ‘আজকের প্রজন্ম’। গল্প শুরু হল জীবনের সব ডিপার্টমেণ্টে হেরে যাওয়া এক অতি সাধারণ বোকাসোকা তরুণ হারু কে নিয়ে।

3Angels
সোমশিখা মজুমদার, অনন্যা গুপ্ত ও সুস্মিতা চৌধুরী
সৌজন্যঃ পার্থ শীল

আগের দিনের ইউরোপীয় নাটকে মৃত আত্মা নয়তো অ্যাঞ্জেলদের দেখা মিলত। তারা সব জানত - ভূত, ভবিষ্যৎ সব কিছুই। অনেকটা সেই প্যাটার্নে মঞ্চে সাদা পোষাক পরা তিন কন্যা হারুকে ঘিরে ধরে নাচল। অপেরার মেজাজে সুরেলা গলায় গাইল বাংলা গান, যার সুর পাশ্চাত্য কর্ডে বসানো তবু প্রচন্ড রকমভাবে দেশী। অনেকটা মহালয়ার চন্ডীপাঠের ‘রূপং দেহি, জয়ং দেহি’র মত সুর। কিন্তু অনন্য। যন্ত্রানুসঙ্গ পরিমিত।গানের কথা ও ভালো। শিল্পীরা ও ভালো গেয়েছেন। বলা যেতে পারে এটা ছিল নাটকের প্রিল্যুড।

Kishore
অণির্বাণ রায় ও দেবরাজ পুরকায়স্থ। সৌজন্যঃ পার্থ শীল

নাটকে এমন এক সময়ের কথা বলা হয়েছে যখন নকল ফুলের ভীড়ে আসল ফুল হারিয়ে যেতে বসেছে। মস্ত শহরের এক কোনায় কোনরকমে টিঁকে আছে একমাত্র ছোট্ট সবুজ পার্ক। সময়ের ছবিটা যেন বর্তমান ও ভবিষ্যতের এক কোলাজ।

Kishore
মল্লিকার ভূমিকায় রাজদুলালী মজুমদার। সৌজন্যঃ পার্থ শীল

গল্পের শুরুটা এরকম। হারু ভালোবাসে মল্লিকা নামের একটি মেয়েকে। কিন্তু মনের কথা আজো মুখ ফুটে বলা হয়ে ওঠেনি। ‘শ্বেতপরী’ দের কথায় সাহস পেয়ে হারু ঠিক করল সত্যিকারের আসল ফুল হাতে নিয়ে অফিস ফেরত মল্লিকার সাথে দেখা করবে। আর মনের কথাটা আজ বলেই ফেলবে।

অফিসে পৌঁছে হারু বসের হাতে প্রচন্ড বকুনি খেল। একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বিজ্ঞাপন তৈরীর কাজ হাতে এসেছে। বিজ্ঞাপনের থীম যে করে, সে অসুস্থ। বসের মেজাজ খারাপ। আজ ওবেলা ছুটির দরকার ছিল। হল না। এর মধ্যেই চালাক চতুর কর্মী বাবলু সিং একটা আইডিয়া দিল যা বসের পছন্দ হল। ঠিক হল, একজোড়া প্রফেশনাল হিরো হিরোইন আর বোকাসোকা দেখতে হারুকে নিয়ে শুটিং হবে। সেই সবেধন নীলমণি পার্কে। আজই।

আর না। এখানেই দাঁড়ি টানা ভালো। সবটুকু বলে দিলে নাটক দেখার মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে।

Haru
অরিত্র বাবাই ধর ও অণির্বাণ রায়। সৌজন্যঃ পার্থ শীল

নাট্যকার ইন্দ্রনীল সুপরিচিত সাহিত্যিক স্বর্গীয় গণেশ দে র সুযোগ্য ‘বাপ কা বেটা’। কিছু নাটকে জ্ঞানগর্ভ বাণী বিনামূল্যে বিতরণ করার একটা ব্যাপার চোখে পড়ে। এতে দর্শকদের ইনসমনিয়া কাটে, ঘুম পায়। আনন্দের কথা ‘আজ বসন্ত’ এর নাট্যকার ও পরিচালক কেউই লেকচার দেওয়ার কোন চেষ্টা করেন নি। শুধু একটা গল্প বলে গেছেন। গল্প শুনতে সবাই ভালোবাসে। তবে ভালো গল্প বলাটা কিন্তু সহজ নয়। বলতে গিয়ে আমরা অনেক সময় বেশি বলে ফেলি। পাঠক, দর্শক, শ্রোতাদের ও যে বুদ্ধি আছে, হৃদয় আছে তা ভুলে যাই। অনেক ভারী ভারী কথা খুব সহজে বলে দিয়ে এই নাটকটি আমাদের ভাবতে শেখাল - গান যেমন একাকী গায়কের নয়, তেমনি নাটক ও বোধহয় আদ্ধেকটা দর্শকের।

বরাক উপত্যকায় মঞ্চাভিনয়ে যাত্রা টাইপের একটা হালকা ছাপ আজো মুছে যায় নি। আনন্দের কথা, অভিনয় স্টাইলের শীতসুলভ এই জড়তা ‘আজ বসন্ত’ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। একটা সময় ভুলেই গেছিলাম যে নাটক দেখছি।

Kishore
শুভন দাস ও অণির্বাণ রায়। সৌজন্যঃ পার্থ শীল

বিজ্ঞাপন কোম্পানীর বসের ছোট্ট রোলে সায়ন বিশ্বাসের সুযোগ কম ছিল। যতটা ছিল তাকে পুরো কাজে লাগিয়েছেন তিনি। বাবলু সিং এর চরিত্রটি অণির্বাণ রায় খুব ভালো বুঝেছেন। সরল সোজা নেহাত ভালোমানুষ হারু চরিত্রটির সাথে নিজের চালাকচতুর করিতকর্মা চরিত্রের কণ্ট্রাস্ট তিনি ভালোই ফুটিয়ে তুলেছেন।

হারুর চরিত্রে অরিত্র ধর যতটুকু করেছেন তার থেকে আর বেশী করলেই বাড়াবাড়ি হয়ে যেত। আগাগোড়া সংযম বজায় রেখে স্টেজে ও যে আন্ডার অ্যাক্টিং করা যায় সেটা এই নাটক দেখে পরিষ্কার বোঝা গেল।

মল্লিকা চরিত্রটি অত্যন্ত ছোট। কোন ডায়লগ ও নেই। তবু বলব, রাজদুলালী মজুমদার ভালো করেছেন।

নাটক – আজ বসন্ত
রচনা- ইন্দ্রনীল দে       নির্দেশনা ও সংগীত পরিচালনা- সায়ন বিশ্বাস       প্রযোজনা- ‘আজকের প্রজন্ম'

অভিনয়ে
   হারু- অরিত্র বাবাই ধর         বাবলু সিং – অণির্বাণ রায়       কোম্পানীর বস- সায়ন বিশ্বাস
     হিরো- দেবরাজ পুরকায়স্থ       মল্লিকা- রাজদুলালী মজুমদার       মল্লিকার বাবা- শুভন দাস
     অ্যাঞ্জেল ১- সোমশিখা মজুমদার       অ্যাঞ্জেল ২- অনন্যা গুপ্ত       অ্যাঞ্জেল ৩- সুস্মিতা চৌধুরী

গানে
বিবর্তন, হাইলাকান্দি

ম্যাগনিফায়িং লেন্স হাতে নিলে নাটকের খুঁত হয়ত পাওয়া যাবে। কিন্তু খুঁজতে ইচ্ছে করছে না। সুরের সামান্য হেরফের হলে ও দরদী গায়কের গান যেমন শ্রোতা ও বিচারকের বুকে চাক্কু মেরে দিতে পারে, এই প্রযোজনাটি ও তেমনি। আর সবচাইতে বড় পাওনা হল, নাটকের তরুণ প্রজন্ম দেখা দিল - যারা পারবে। শীত না পড়তেই একঝাঁক বসন্তের দেখা পেয়ে সবাই খুশী। বিশেষ করে যারা নাটককে নিজের সন্তানের মতই ভালোবাসেন।

Sayan
সায়ন বিশ্বাস। সৌজন্যঃ পার্থ শীল

নির্দেশক সায়ন বিশ্বাস শুরুটা করেছিলেন অপেরা স্টাইলে। অন্য উপায় ছিল না। তাঁকে বলতে হচ্ছিল এমন এক গল্প যা রূপকথাতেই মানায়, বাস্তবে নয়। কিন্তু, কী আশ্চর্য, শেষের সীনে স্বতস্ফূর্ত হলভরা হাততালি শুনে বোঝা গেল- নকল নয়, মনে মনে আজো আমরা সবাই আসলকেই ভালোবাসি। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে কোথায় যেন লুকিয়ে ছিল একটুকরো ভীরু বসন্ত। সায়ন তাকে বের করে আনলেন।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ঠিকই বলেছিলেন। মন চাইলেই বসন্ত আসে। সে ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক। ‘নতুন প্রজন্ম’ তা আরেকবার প্রমাণ করল।

– ত্রিদেব চৌধুরী

View Author Profile

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

আমি করোনা বলছি

(You may use Landscape mode for a better view, if you are reading this on your phone.) হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন। আমি করোনা ভাইরাস বলছি। করোনা পরিবারের সপ্তম সদস্য। আপনারা আমাদের নাম রেখেছেন নভেল করোনা ভাইরাস (2019-nCoV) - অর্থাৎ নব্য করোনা ভাইরাস। খুব মিষ্টি নাম কিন্তু। ২০১৯ এর শেষের দিকে চীনের উহান প্রদেশে আমাদের জন্ম। ঘটনাটা খুলেই বলি। চীনেরা প্যাঙ্গোলিন মেরে মেরে শেষ করে দিচ্ছিল। প্যাঙ্গোলিনেরা তখন আমাদের রিকোয়েস্ট করল কিছু একটা করার জন্যে। আমাদের গুরুজনেরা বাদুড়ের শরীরে আগে থেকেই মজুত ছিলেন। সেখান থেকে টুক করে তাঁরা প্যাঙ্গোলিনের শরীরে ঢুকে পড়লেন। প্যাঙ্গোলিনের দেহে ঢোকার পর তাঁদের রূপ পরিবর্তন হয়ে আমাদের জন্ম হল। সেখান থেকে আমরা মানুষের দেহে ঢুকে পড়লাম। আক্রমণ শুরু হল। অবাক হচ্ছেন? আমরা মানে ভাইরাসেরা অনেক রকম কায়দা জানি। আপনারা অত কিছু ভাবতেই পারবেন না। আপনাদের চোখে আমরা বেশ রহস্যময়। আমরা জীব নাকি জড় - এ ব্যাপারে আপনাদের বিজ্ঞানীরা এখনো ঠিক যাকে বলে পুরোপুরি ‘সিওর’ হতে পারেন নি। কারণ, আমরা ঠিক সেল বা জীবকোষ নই। নিছক জেনেটিক মালমশলা (নিউক্লিক এসিড) - প্রোটি

অচিন পাখী

ক্লা স নাইনে আমার এক স্যার বলেছিলেন, ‘চাইলে তুমি ফিউচারে যেতে পারবে।‘ মনটা আনন্দে নেচে উঠেছিল। টাইম মেশিনের গল্প আগেই পড়া ছিল। সেটা তাহলে এবার সত্যি হতে চলেছে? জানতে চেয়েছিলাম, কীভাবে? জবাবে স্যার যা শুরু করলেন, তাতে আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। বাপ রে বাপ। বেজায় কঠিন। আগে জানলে একটু ও উৎসাহ দেখাতাম না। আমার মনমরা ভাব দেখে স্যার বললেন, ‘অঙ্কে যাদের আতঙ্ক তাদের জন্য এসব বোঝা মুশকিল।‘ ‘ভালো ভালো জিনিষ তো জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তাই বলে অঙ্ক? আমি ওতে নেই।‘ জোরে বলার সাহস নেই। তাই মনে মনেই বললাম। পরে যদি ও বিজ্ঞান শেখার দায়ে অঙ্ক আমাকে শিখতে হয়েছিল। সেসব তো স্টুডেণ্ট লাইফের কথা। এখন ভাবি, আমার মত আরো অনেকেই নিশ্চয় আছেন যারা বিজ্ঞানের নতুন নতুন ব্যাপার জানতে আগ্রহী। কিন্তু ঘুরেফিরে সমস্যা ওই এক জায়গায়। ড্রাগনের মত ভয়ঙ্কর আগুনে অঙ্ক! সেই দুঃখের জায়গা থেকেই নিজেকে একটা চ্যালেঞ্জ দিয়েছি। বিনা অঙ্কে বিজ্ঞানের কথা বলব। যাতে ক্লাস নাইনের ছাত্র ও বুঝতে পারে। টাইম মেশিনে চড়ে যদি অতীত বা ভবিষ্যতে যেতে হয় তবে প্রথমেই যে প্রশ্নটি আসবে তা হল অতীত, ভবিষ্যত, বর্তমান কা

বড্ড কাঁটা, আস্তে গিলিস!

স ন্ধে থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল। গিন্নী যুত করে বানিয়েছিলেন আমার অত্যন্ত প্রিয় পদ সরষে ইলিশ। খুব মজা করে খাচ্ছিলাম। গিন্নী বলছিলেন বটে রাতের বেলায় সরষে বেশি খেও না, পেট গরম হবে, বয়স তো কম হয় নি ইত্যাদি। সরষে ইলিশের সাথে এরকম ঘ্যানর ঘ্যানর করলে মানায় কখনো, বলুন! আমি সেদিকে কান না দিয়ে গপাগপ খেয়েই যাচ্ছিলাম। মাঝখানে গলায় একবার কাঁটা ও আটকে গেছিল। যাই হোক, খেয়েদেয়ে তারপর ঠিক এগারোটায় শুয়ে পড়েছি। মাঝরাতে হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘুমচোখে দরজা খুলে দেখি, একি! আমার তিনতলার ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে স্বয়ং কিশোর কুমার !!! পরনে একটা ঢিলে জোব্বা মত পোষাক। এরকম একটা অদ্ভুত সাজে আগে তাঁকে কখনো দেখি নি। কিশোর কুমার তো একটু ইয়ে - মানে মাথায় একটু ছিট তো আগে থেকেই ছিল। নিজের বাড়ীতে না কি সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলেন, ‘কিশোর কুমার হইতে সাবধান!’ সবই মুডের ব্যাপার। আজকের পোষাকটা ও সেই মুডেরই বহিঃপ্রকাশ হবে হয়তো। সাথে কে একজন লম্বা, দাড়ি অলা, বুড়ো মত লোক। কোথায় যেন দেখেছি লোকটাকে। লোকটা পরে আছে কোট প্যাণ্ট, আর হ্যাট। অনেকটা যেন কিশোর কুমার স্টাইল। যাই হোক, মাঝরাতে কিশোরদা কে দেখে আম