নের অনুষ্ঠান বললেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে এক পরিচিত ছবি। এয়ার কন্ডিশন্ড হলের বিশাল স্টেজের পেছনটায় কর্পোরেট ব্যাকড্রপ, চারপাশে ঝলমলে ব্যানার, গানের শেষে 'বাইরের' শিল্পীর সাথে আয়োজকদের 'সেলফি', পরের দিন খবরের কাগজের সংস্কৃতির পাতায় জমকালো ছবিসহ প্রতিবেদন এবং সবশেষে ফেসবুকে লাইকের বন্যা। ‘সমকাল’-এর মাসিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘প্রয়াস’ এসবের ধারই ধারে না। প্রেমতলার ‘জননী এপার্টমেণ্ট’ -এর গ্রাউণ্ড ফ্লোরের পেছনের দিকটাতে পার্ক করা গাড়ীগুলো আপাতত সরিয়ে কোনমতে খাড়া করা অস্থায়ী স্টেজ, যার পোষাকি নাম ‘স্বর্ণজিৎ নাথ স্মৃতি মঞ্চ’, সামনে খান তিরিশেক লাল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার, যা হোক গোছের একটা শব্দ-ব্যবস্থা, আর দর্শক শ্রোতাদের জন্যে চা বিস্কুট - ব্যস। এরকম একটা সাধারণ সেট আপের মধ্যে সমকাল সাংস্কৃতিক সংস্থা একটা নয়, দুটো নয় একেবারে ১২৭ খানা এপিসোড নামিয়ে দিয়েছে- ভাবা যায়?
মাসের একটি বিশেষ রবিবারে সন্ধ্যের দিকে বসে এই আসর। শ্রোতা সংখ্যায় কম, সমঝদারিতে ভারী। শ্রুতিনাটক, আবৃত্তি থেকে শুরু করে গান, যন্ত্রসংগীত - কী না হয় সেখানে! থাকে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ নিয়ে বক্তব্য ও। নামী ও অনামী দুই ধরণের শিল্পীরাই এতে অংশ নেন। নতুন সম্ভাবনাদের তুলে আনা ও এর একটা উদ্দেশ্য। অনুষ্ঠানে কোন জাঁকজমক নেই কিন্তু আন্তরিকতা আছে, আছে সুস্থ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিষ্ঠা এবং নিরলস প্রয়াস। যা দেখে রবীন্দ্রনাথের সেই গানটি মনে পড়ে, 'একমনে তোর একতারাতে একটি যে তার সেইটি বাজা'।
শতসপ্তবিংশতিতম ‘প্রয়াস’ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল রবিবার, ৮ই অক্টোবর, ২০১৭। শিল্পীরা ছিলেন গানে সাগরিকা দেবরায় ও অবন্তিকা দেবরায় এবং আবৃত্তি তে সৃজা চন্দ। প্রথমে সাগরিকা, তারপর সৃজা ও সবশেষে অবন্তিকা।
সাত সকালে সাগরিকাকে ইউনিভার্সিটির বাস ধরতে হয়। ও বাড়ী ফেরে ঠিক বারো ঘণ্টা পর, ‘সাত’ সন্ধ্যায়। গান বাজনা করার সময় সেভাবে তার নেই। সাগরিকা কিন্তু এদিন সবাইকে চমকে দিয়েছে। তার আওয়াজটি খুব ধারালো, মিষ্টি ও সুরেলা। যেভাবে সে একের পর এক শক্ত গানকে স্বমহিমায় দাঁড় করিয়ে দিল, ভাবা যায় না! এবং সেসব যে সে শিল্পীর গাওয়া গান নয়। আশা ভোঁসলে (‘ফুলে গন্ধ নেই’) থেকে শুরু করে হৈমন্তী শুক্লা (‘আমি অবুঝের মত’) ও শুভমিতার (‘বাতাস ডাকে না আগের মত’) করা গান সে গাইল সাবলীল ভাবে। এ মেয়েকে একবছর রেওয়াজ করার ‘সশ্রম কারাদণ্ড’ দিলে গান গেয়ে একেবারে কাঁপিয়ে দেবে। সবশেষে দর্শকের অনুরোধে তাকে গাইতে হল শ্রেয়া ঘোষালের ‘’উড়ে যাও তুমি’।
ছোট্ট মেয়ে সৃজা পরপর আবৃত্তি করে শোনাল রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন (‘মা গো, আমায় ছুটি দিতে বল্’), সুকুমার রায়ের জীবনের হিসাব (‘বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই’)ও ঠিকানা (‘আরে আরে জগমোহন’), সুকান্তের ছাড় পত্র (‘যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে’), অপূর্ব দত্তের বাংলা টাংলা, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সুন্দরী ঝর্ণা, এবং শেষে রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন নামেরই আরেকটি কবিতা (‘ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ’)। ভালো হয়েছে। সৃজার বয়স কম, দিনে দিনে তার আবৃত্তি আরো ভালো হবে। কিছু ছোটখাটো কথা শুধু মাথায় রাখা চাই। আসলে, আবৃত্তি সহজ বলেই হয়ত কঠিন।
অবন্তিকার বয়স ও কম। কিন্তু সে অনভিজ্ঞ নয়। ইতিমধ্যে তার রবীন্দ্রসঙ্গীতের নিজস্ব এলবাম ও বেরিয়ে গেছে। রীতিমত তালিম নেওয়া রেওয়াজি গলা, একদম ট্র্যাডিশনাল ভয়েস। আমরা যারা সুচিত্রা মিত্র, নীলিমা সেন, ঋতু গুহ দের গান শুনে বড় হয়েছি তাদের জন্য অবন্তিকার গান পুরোনো দিনের নস্টালজিক মেজাজ নিয়ে আসে। তবে সে এখন ও শিখছে। শিখুক, আরো বড় হোক। অবন্তিকা এদিন বেছে নিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের শারদীয় কিছু গান। সমস্যা একটাই, বাইরে তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। অবন্তিকা নিজেই বলল ‘শরত ভেবে গাইতে এসেছিলাম, এখন দেখছি বর্ষা’। তারপর গান ধরল। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টির জন্যেই বোধ হয় অবন্তিকার গলায় শরত ঠিকঠাক ধরা দিচ্ছিল না। সে নিজস্ব ছন্দে ফিরল ‘চোখের জলের লাগল জোয়ার’ গানটির হাত ধরে। চির অভিমানী পিলু রাগ, কবিগুরুর নিখুঁত কম্পোজিশন আর অবন্তিকার সুরেলা আবেগ - সব মিলিয়ে কেস একেবারে জন্ডিস! কিছু জিনিষ আছে যা হাতের নাগালে থেকে ও চিরদিনই দূরে থেকে যায়। শুদ্ধ নিষাদ থেকে ‘তার ষড়জ’-এ পৌঁছতে না পারার ব্যথা বুকে নিয়ে পিলু রাগের বিরহী আত্মা যেন অবন্তিকার ডাকে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। বর্ষার দমকা বাতাসে তার মনখারাপের হাহাকার ভরা দীর্ঘ নিশ্বাস বুকের ভেতর সবাইকে ছুঁয়ে গেল। শ্রোতারা স্তব্ধ। বাইরে তখন আর বৃষ্টি পড়ছিল না।
যেসব যন্ত্র শিল্পীরা এদিন প্রতিটি গানকে ফুটে উঠতে সাহায্য করলেন তারা হলেন কানাইলাল দাস (কীবোর্ড), অসীমানন্দ বিশ্বাস (তবলা), বিশ্বজিৎ দেব ওরফে শঙ্কু (তবলা) ও সত্য রঞ্জন রায় (মন্দিরা)। উপস্থিত দর্শক শ্রোতাদের জন্যে উপরি পাওনা ছিল মাংসের গরম চপ আর চা। বৃষ্টির জন্যে যারা এলেন না তারা বোধহয় সবকিছুই মিস করলেন। তরুণ তুর্কীরা একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছে।
অধীর আগ্রহে আমরা এবার তাকিয়ে থাকব পরের মাসের একটি রবিবাসরীয় সন্ধ্যার দিকে। যেদিন আবারো ম্যাজিকের মত বদলে যাবে দৈনন্দিন জীবনের আটপৌরে চারপাশ, তক্তপোশের ওপর শতরঞ্চি পাতা জায়গাটা হয়ে উঠবে স্টেজ, সুস্থ সংস্কৃতির নাড়ীর টানে আবারো সবাই জড়ো হব সেই উজ্জ্বল উপস্থিতির চারপাশে- যার নাম ‘প্রয়াস’। বেঁচে থাকুক সমকাল। ‘ষাট ষাট’!
ত্রিদেব, অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য নাহলেও আপনার লেখা এক অদ্ভুত রুপকল্প তৈরী করে সাহিত্য এবং সংস্কৃতি - দুটোরই অনাবিল আনন্দ প্রদান করলো। মনে হচ্ছে 'না পড়লে হয়তো পিছিয়ে পড়তাম'! কেয়াবাত!
ReplyDeleteআপনার গদ্য শৈলী দারুণ। আগেও যুগশঙ্খে পড়েছি। এটি একটি আকর্ষণীয় প্রতিবেদন । আশা করছি, অনেকেই অনুপ্রাণিত হবেন।
ReplyDelete