Skip to main content

নাটকঃ লিগ্যাসি কোড ১৯-০৫-১৯৬১



ছো

টবেলায় পড়েছিলাম কলম নাকি তলোয়ারের চেয়ে অনেক ধারালো, অনেক শক্তিশালী। এতদিন তাই ভাবতাম। এখন লিখতে বসে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। বুধবার বঙ্গভবনে যে নাটক দেখলাম তাকে কাগজের পাতায় ফুটিয়ে তোলার কনফিডেন্স অন্ততঃ আমার কলমে নেই। নাট্যকার অরিজিৎ আদিত্য ও নির্দেশক অভিনেতা সুব্রত রায়ের প্রতিভার সামনে নতজানু হয়ে এ লেখা লিখছি।

Cover
গ্রাফিক্স ডিজাইনঃ ডঃ রাজীব কর

নাটকটি প্রথমবার মঞ্চস্থ হয়েছিল দিল্লীতে। এবার শিলচরে হল। এ নাটকের যেটা ক্যানভাস, দুরূহ বাংলায় যাকে বলে পটভূমিকা, সেটা বরাক উপত্যকার তো বটেই গোটা অসমের সবারই জানা। তবে ভারতবর্ষের বেশির ভাগ লোকই এ নিয়ে খুব একটা কিছু জানেন না।

গল্পের মুখ্য চরিত্র অর্জুন নমশূদ্র এক ‘ডি-ভোটার’। এই ‘ডি-ভোটার’ বা ডাউটফুল ভোটার শব্দটি অসমের বাঙালীদের জন্যে আতঙ্কের অপর নাম। কারো নামে একবার যদি এই ‘ডি-ভোটার’ নোটিস আসে তবে তিনি নিজভূমেই পরবাসী হয়ে গেলেন। তাঁকে এবার আদালতে প্রমাণ করতে হবে তিনি ভারতের নাগরিক। মাননীয় গৌহাটি হাইকোর্টের আদেশ মত বিচার না হওয়া পর্যন্ত ‘ডি-ভোটার’ দের ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক করে রাখতে হয়। রাজ্যের অনেক জায়গায় জেলগুলিকেই ডিটেনশন ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে, যার নাগরিকত্ব সন্দেহজনক তাকে বন্দীজীবন কাটাতে হচ্ছে চোর ডাকাত খুনী দের সাথে। বছরের পর বছর এভাবে বিনা বিচারে বন্দী জীবন কাটানোর পর কেউ কেউ মারা যাচ্ছেন, নয়ত আত্মহত্যা করছেন। নাটকের হিরোকে নাট্যকার বাস্তব জীবন থেকেই ধার করেছেন। বাস্তবের অর্জুন নমশূদ্র যদি ও শেষমেশ আত্মহত্যার পথই বেছে নিয়েছিল। নাটকের অর্জুন কিন্তু তা করে নি।

Kishore
অর্জুন নমশূদ্রের ভূমিকায় সুব্রত রায় শম্ভু। সৌজন্যঃ পার্থ শীল

নাট্যকার খুব গুছিয়ে অর্জুন নমশূদ্রের গল্পটা বলেছেন। একদম ডিটেলে। এবং সমস্যার সমাধান কোন পথে, সব শেষে তাও বলেছেন।

হাওর থেকে মাছ ধরে অর্জুন তার সংসার চালাত। ‘মৎস্য মারিব খাইব সুখে’ কথাটা তার বেলায় ও খাটত শুধু যদি ওই নোটিস টা আসত না। নিজের লিগাসি কোড না জানলে এনআরসি র খাতায় নাম উঠবে না। নিজেকে এ দেশের নাগরিক বলে প্রমাণ করা যাবে না। অর্জুন তাই হন্যে হয়ে তার নিজের শেকড়কে খুঁজছিল।

নাটকের পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল দেশভাগের যন্ত্রণা, আমাদের বাপ ঠাকুর্দাদের কষ্ট। শুধু মাটি দিয়ে তো একটা দেশ গড়ে ওঠে না। তার সাথে জুড়ে থাকে সেখানকার মানুষের সুখ, দুঃখ, আবেগ, ভালোবাসা। সেই আবেগ যে কতবার খণ্ডিত হয়েছে, অপমানিত হয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে তার হিসেব হয়তো ইতিহাসে নেই বা থাকবে ও না। এই নাটকটি যেন তার এক অসামান্য দলিল হয়ে রইল।

Haru
সৌজন্যঃ পার্থ শীল

দেশ ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। নাট্যকার কিন্তু সব শেষে মেসেজ দিলেন ধর্ম নয়, ভাষাই হচ্ছে আমাদের আসল ঐতিহ্য, আমাদের অকৃত্রিম লিগ্যাসি। তার কোড ১৯শে মে,১৯৬১। ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে যেদিন এগারোটি তাজা প্রাণ শহীদ হয়েছিল। শুধু অর্জুন নয়, আমাদের সবারই ওই একই লিগ্যাসি কোডঃ ১৯-০৫-১৯৬১।

অরিজিৎ বাবু সোজাসুজি মানবাধিকারের কথাই বলেছেন। ভেদাভেদ ভুলে বাংলা মায়ের আঁচলের ছায়ায় এসে নতুন করে একসাথে পথ চলার ডাক শেষের দিকে একেবারে সুস্পষ্ট।

এবারে আসি অভিনয়ের কথায়। নেতার চরিত্রে বিভাস রায় ও শহীদ কমলা ভট্টাচার্য র ভূমিকায় রুমি রায় যথাযথ। এত কম সময়ে এর বেশি তাদের করার কিছুই ছিল না। এক ঘণ্টা দশ মিনিটের নাটকে এই দুজনকে মঞ্চে দেখা গেছে যথাক্রমে তিন মিনিট ও পাঁচ মিনিট।

Kishore
সৌজন্যঃ পার্থ শীল

সুব্রত বাবু একাই প্রায় দশটি চরিত্রে অভিনয় করলেন। শুরুতে একটু অবাক হচ্ছিলাম। 'গণসুর'-এ দক্ষ অভিনেতার তো কোন অভাব নেই। তবে? নাটক একটু এগোতেই কারণটা বোঝা গেল। দেখলাম অতগুলি চরিত্রে রূপদান করে সুব্রত রায় অভিনয়ের ব্যাপারটাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। হলভর্তি দর্শক হাঁ করে সুব্রত বাবুর কাণ্ড কারখানা দেখছিলেন। বঙ্গভবনের অত বড় স্টেজে তিনি যে একাই অভিনেতা তা কাউকে বুঝতেই দিলেন না। মনে হচ্ছিল, সমস্ত চরিত্রগুলো মঞ্চ জুড়ে চলাফেরা করছে, ডায়লগ বলছে। কস্টিউম, মঞ্চসজ্জা, প্রপস্ এসবকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে শুধুমাত্র দর্শকের কল্পনা শক্তির ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতার ওপর ভরসা রেখে একাই নাটক টেনে নিয়ে গেলেন সুব্রতবাবু। অভিনয় একটা পারফর্মিং আর্ট, সুব্রত বাবু আবার নতুন করে প্রমাণ করলেন। এমন কি ইমোশনাল দৃশ্যে ও তিনি ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ। দিদিমার অর্জুনকে বুকে জড়িয়ে ধরা কিংবা মিজান চাচা ও অর্জুনের কোলাকুলির দৃশ্যে দর্শকদের স্বতস্ফূর্ত হাততালিতে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তাঁর একক অভিনয়ের শিল্প কুশলতা। সুব্রতবাবুর এই যে ম্যাজিক, একে ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। যারা দেখেন নি তারা বড্ড মিস করলেন।

Kishore
সৌজন্যঃ পার্থ শীল

সেবায়ন রায় চৌধুরীর আবহ বেশ ভালো। শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের গাওয়া দুটি গান একেবারে বুকে এসে লাগে। সুরে মোড়া ব্যথা যেন মিছরির ছুরি। বাংলা ফোক যে তিনি অত ভালো গাইতে পারেন, আগে জানতাম না। একা নাটক করতে গেলে আলোর একটা বিশেষ ভূমিকা থাকেই। এখানে ও ছিল। আলোর কাজ ও ভালোই বলতে হবে।

সবশেষে প্রাণভরা ধন্যবাদ জানাতে হয় শিলচরের ভাষা শহীদ স্টেশন স্মরণ সমিতি ও দিল্লীর যুক্ত ফাউণ্ডেশন কে। এ কাহিনী তো একা অর্জুন নমশূদ্রের নয়, এ আমাদের সবার গল্প। ভুল বললাম, গল্প কেন হবে? এ তো সত্য। আগুনে পোড়া সোনার মত ষোল আনাই খাঁটি। আমাদের কষ্টের কাহিনীকে দিল্লীর মঞ্চে সবার সামনে তুলে ধরলেন তারা। এর জন্যে বিশেষ করে যুক্ত ফাউণ্ডেশনের সুবিমল ভট্টাচার্যের কাছে আমরা সবাই ঋণী। শিলচরের মঞ্চায়ন ও সম্ভব হয়েছে এদেরই সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায়। আমাদের বঞ্চনার কথা এতদিন আমরা লোকের কাছে পৌঁছে দিতে পারি নি। এই বোধ হয় তার শুভারম্ভ হল। দরকার ও ছিল। কারণ, নাটক তো শুধু শিল্প নয়, সংগ্রাম ও বটে।

(আরো পড়তে চান? আমার ফেসবুক পেজ লাইক করে রাখুন। নতুন লেখা বেরোলেই আপনার কাছে খবর চলে আসবে।)

– ত্রিদেব চৌধুরী

tridev
View Author Profile

Comments

  1. অনবদ্য পর্যালোচনা।
    অভিনন্দন দাদাভাই।।

    ReplyDelete
  2. পড়লাম। ভালো লাগল।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

আমি করোনা বলছি

(You may use Landscape mode for a better view, if you are reading this on your phone.) হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন। আমি করোনা ভাইরাস বলছি। করোনা পরিবারের সপ্তম সদস্য। আপনারা আমাদের নাম রেখেছেন নভেল করোনা ভাইরাস (2019-nCoV) - অর্থাৎ নব্য করোনা ভাইরাস। খুব মিষ্টি নাম কিন্তু। ২০১৯ এর শেষের দিকে চীনের উহান প্রদেশে আমাদের জন্ম। ঘটনাটা খুলেই বলি। চীনেরা প্যাঙ্গোলিন মেরে মেরে শেষ করে দিচ্ছিল। প্যাঙ্গোলিনেরা তখন আমাদের রিকোয়েস্ট করল কিছু একটা করার জন্যে। আমাদের গুরুজনেরা বাদুড়ের শরীরে আগে থেকেই মজুত ছিলেন। সেখান থেকে টুক করে তাঁরা প্যাঙ্গোলিনের শরীরে ঢুকে পড়লেন। প্যাঙ্গোলিনের দেহে ঢোকার পর তাঁদের রূপ পরিবর্তন হয়ে আমাদের জন্ম হল। সেখান থেকে আমরা মানুষের দেহে ঢুকে পড়লাম। আক্রমণ শুরু হল। অবাক হচ্ছেন? আমরা মানে ভাইরাসেরা অনেক রকম কায়দা জানি। আপনারা অত কিছু ভাবতেই পারবেন না। আপনাদের চোখে আমরা বেশ রহস্যময়। আমরা জীব নাকি জড় - এ ব্যাপারে আপনাদের বিজ্ঞানীরা এখনো ঠিক যাকে বলে পুরোপুরি ‘সিওর’ হতে পারেন নি। কারণ, আমরা ঠিক সেল বা জীবকোষ নই। নিছক জেনেটিক মালমশলা (নিউক্লিক এসিড) - প্রোটি

অচিন পাখী

ক্লা স নাইনে আমার এক স্যার বলেছিলেন, ‘চাইলে তুমি ফিউচারে যেতে পারবে।‘ মনটা আনন্দে নেচে উঠেছিল। টাইম মেশিনের গল্প আগেই পড়া ছিল। সেটা তাহলে এবার সত্যি হতে চলেছে? জানতে চেয়েছিলাম, কীভাবে? জবাবে স্যার যা শুরু করলেন, তাতে আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। বাপ রে বাপ। বেজায় কঠিন। আগে জানলে একটু ও উৎসাহ দেখাতাম না। আমার মনমরা ভাব দেখে স্যার বললেন, ‘অঙ্কে যাদের আতঙ্ক তাদের জন্য এসব বোঝা মুশকিল।‘ ‘ভালো ভালো জিনিষ তো জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তাই বলে অঙ্ক? আমি ওতে নেই।‘ জোরে বলার সাহস নেই। তাই মনে মনেই বললাম। পরে যদি ও বিজ্ঞান শেখার দায়ে অঙ্ক আমাকে শিখতে হয়েছিল। সেসব তো স্টুডেণ্ট লাইফের কথা। এখন ভাবি, আমার মত আরো অনেকেই নিশ্চয় আছেন যারা বিজ্ঞানের নতুন নতুন ব্যাপার জানতে আগ্রহী। কিন্তু ঘুরেফিরে সমস্যা ওই এক জায়গায়। ড্রাগনের মত ভয়ঙ্কর আগুনে অঙ্ক! সেই দুঃখের জায়গা থেকেই নিজেকে একটা চ্যালেঞ্জ দিয়েছি। বিনা অঙ্কে বিজ্ঞানের কথা বলব। যাতে ক্লাস নাইনের ছাত্র ও বুঝতে পারে। টাইম মেশিনে চড়ে যদি অতীত বা ভবিষ্যতে যেতে হয় তবে প্রথমেই যে প্রশ্নটি আসবে তা হল অতীত, ভবিষ্যত, বর্তমান কা

বড্ড কাঁটা, আস্তে গিলিস!

স ন্ধে থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল। গিন্নী যুত করে বানিয়েছিলেন আমার অত্যন্ত প্রিয় পদ সরষে ইলিশ। খুব মজা করে খাচ্ছিলাম। গিন্নী বলছিলেন বটে রাতের বেলায় সরষে বেশি খেও না, পেট গরম হবে, বয়স তো কম হয় নি ইত্যাদি। সরষে ইলিশের সাথে এরকম ঘ্যানর ঘ্যানর করলে মানায় কখনো, বলুন! আমি সেদিকে কান না দিয়ে গপাগপ খেয়েই যাচ্ছিলাম। মাঝখানে গলায় একবার কাঁটা ও আটকে গেছিল। যাই হোক, খেয়েদেয়ে তারপর ঠিক এগারোটায় শুয়ে পড়েছি। মাঝরাতে হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘুমচোখে দরজা খুলে দেখি, একি! আমার তিনতলার ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে স্বয়ং কিশোর কুমার !!! পরনে একটা ঢিলে জোব্বা মত পোষাক। এরকম একটা অদ্ভুত সাজে আগে তাঁকে কখনো দেখি নি। কিশোর কুমার তো একটু ইয়ে - মানে মাথায় একটু ছিট তো আগে থেকেই ছিল। নিজের বাড়ীতে না কি সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলেন, ‘কিশোর কুমার হইতে সাবধান!’ সবই মুডের ব্যাপার। আজকের পোষাকটা ও সেই মুডেরই বহিঃপ্রকাশ হবে হয়তো। সাথে কে একজন লম্বা, দাড়ি অলা, বুড়ো মত লোক। কোথায় যেন দেখেছি লোকটাকে। লোকটা পরে আছে কোট প্যাণ্ট, আর হ্যাট। অনেকটা যেন কিশোর কুমার স্টাইল। যাই হোক, মাঝরাতে কিশোরদা কে দেখে আম